মতিয়ূর রহমান (লিখেছেন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। তিনি এখন করোনাভাইরাস মুক্ত।)

মানুষের, বিশেষত প্রেমিকদের স্বপ্নে দেখা রাজকন্যারা চিরকাল নাকি সাত সাগর আর তের নদীর পারেই থাকে । কিন্তু যমের দূত বা যম নিজেই  যে ঘাপটি মেরে মানুষের শিয়য়ে বসে থাকে তা মানুষ যেমন বিশ্বাস করতে পারে না আবার তেমনি তাকে ঠিক অবিশ্বাসও করে উঠতে পারে না। 

এ সেই রাজ জ্যোতিষীর গল্পের মতো।জ্যোতিষী সবার মৃত্যুর খবর বলতে পারেন কিন্তু তাঁর শাস্ত্র কেবল  ‘ফেল ‘ মেরে যায় তাঁর নিজের বেলাতেই ।  গণনা যা বলে কেন জানি তা বিশ্বাস হয় না। আবার জোরজার করে যদিবা তা বিশ্বাস হয় মন কিছুতেই যেন তা মানতে পারে না। 

করোনা ভাইরাস বা COVID -19 নিয়ে  বিভিন্ন আঙ্গিকের বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছি। অসুস্থ না হলে জুনের ১৯ এবং ২৬ তারিখে হয়তো তা প্রকাশও করে ফেলতাম। তা সে তো হয়ই নি। 

তারও আগে প্রথমদিকের এক লেখায় তো লিখেছিলাম –  এ বছর যেহেতু হজযাত্রা সম্ভব নয়।  ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের তাই উচিত সেই টাকায় একটি আধুনিক মানের হাসপাতালের জন্য চিন্তাভাবনা করা ও একত্রিত হওয়া । বর্তমান সময় ও পরিস্থিতির শ্রেষ্ঠ দাবিও হলো তাই ।  মানুষ সেই ডাকের কোন মূল্য দেয়নি। পুরো নিরুত্তর এবং পরিপূর্ণ উদাসীন থেকেছে ভীষণ প্রয়োজনীয় সেই ডাক শুনেও ।যাইহোক,  মানুষ যখন নিল না তখন করার তো আর কিছু রইলও না । এ এমন এক কাজ যা মানুষের সংযোগ বিনা অসম্ভব ।  আজ আর গল্পকারের গল্প না। আজ করোনা ভাইরাস বা কোভিড পজিটিভ এক রোগীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শুনছেন আপনারা। যিনি নিজের মুখেই ঝাল খেয়েছেন অর্থাৎ করোনা কী তা জেনেছেন। এ সেই কথা।  

কোথা থেকে আর কীভাবে যেন জীবন মৃত্যুর শিক্ষা ও ধারণাটা খুব পরিস্কারভাবে আছে ভিতরে ভিতরে।  –  মৃত্যুকে আমি জীবনের ধ্রুবসত্য বলেই জানি। তাই মৃত্যুর নিশ্চয়তা ও অভ্রান্ততা নিয়ে কোন অস্পষ্টতা নেই আমার মাঝে । এও জানি, সঠিক ও যথোপযুক্ত সময় এলে তার হাত থেকে পালাবার পথ নেই কারো । জানি, এ জগৎ মরজগৎ । এখানে জীবের জন্ম হয় শেষাবধি মৃত্যুর হাতে  নিজেকে সমর্পণ করার জন্যই । ঠিক ফুল যেমন।  ঝরে যাওয়ারই জন্য সে ফোটে। এই হলো প্রাকৃতিক নিয়ম। এই হলো নিয়তি । এই হলো ঈশ্বরের খেলা।  যে যেমনভাবে দেখবে ও ভাববে । 

ভীমসেন মার্কা চেহারা আমার কোনদিনই ছিল না। শ্বাসকষ্টজনিত কিছু সমস্যা সারাবছর আমার সঙ্গী। বলতে গেলে সারাজীবন ওষুধ খেয়ে আর জোড়াতালি দিয়েই পার হচ্ছি ও হয়ে চলেছি জীবনের তরঙ্গবিক্ষুব্ধ ছোট বড়ো সেসব নদী। 

করোনা বা কোভিড দৈত্য যখন ভারতীয় এবং বঙ্গীয় আকাশকে  কালো মেঘের মতো ঘিরে ধরলো আর চেপে বসল তখন সবার মতো আমিও বেশ আতঙ্কিত হলাম। আমার আতঙ্কটা অনেক বেশি। কারণ আমার চিরকালীন দুর্বল স্বাস্থ্য। তায় আবার সে সমস্যা শ্বাসের সাথে যুক্ত। ” যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয় “। এ তো জানা কথা । আমিও জানতাম যেকোনো দিন ওটাই হয়তো হয়ে যেতে পারে  আমার অতিরিক্তের অতিরিক্ত দুর্বল জায়গা। হয়েও গেল তাই ।  বাংলার বাতাসে মৌসুমি বাতাস ঢুকে গেছে,  আষাঢ় একেবারে পড়ি পড়ি ।

এমন এক সময় দেখা দিল ও শুরু হলো শ্বাসকষ্ট। প্রথমে ভাবলাম প্রতিবছরের মতো ঋতুবদলের এই উপহার তো নিতেই হবে। সেইমত ডাক্তার দেখানো হলো । কিন্তু অন্যান্য বারের মতো এবার সে আর যেন বাগ মানে না কিছুতেই । একতিল বাতাস যেন আর ঢোকে না বুকে। শ্বাসের জন্য এ লড়াই যে না করেছে তাকে বোঝানো যাবে না – শ্বাসকষ্ট জিনিসটা আসলে কী এবং কেমন ! 

বাড়িতে থেকে প্রাণান্তকর লড়াই দিলেও চেতনা আমার পরিস্কার। আমি সব বুঝতে পারছি। অবশেষে মাত্র তেইশ বছরের ইন্টার্ন ডাক্তার ছেলেটি রাত ন-টায় মায়ের ফোন পেয়ে হসপিটাল ছেড়ে হলদিয়া থেকে চলে এলো মাঝরাতেই আর সারারাত ঘর ও বার দুই সামলালো সে একাই। এক রাতেই সে যেন হয়ে গেল অনেক বড় ও দায়িত্ববান। আসলে প্রয়োজন হল সব, প্রয়োজনই মানুষকে দুমড়ে মুচড়ে যা বানাবার তা বানিয়ে নেয়। 

সেই অবস্থায় সামনে থেকে যে কারো কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না তা তো সবার জানা। প্রাণের ভয় নেই কার ! এবং সেটাই খুব স্বাভাবিক। দিদি – জামাইবাবু, অগ্রজ দাদা ইমরোজ নাওয়াজ রেজা, তার ডাক্তার শিক্ষক, সিনিয়র দাদা ও বন্ধুদের সাথে শুধু ফোনেই পরামর্শ করে সে ঠিক করেই নিল তার কর্তব্য। কেউ তো সামনে আসবে না। আসার কথাও না। এই পরিস্থিতিতে তা কারো কাছে আশাকরা উচিতও না। ফোন হলো একমাত্র মাধ্যম যা দিয়ে কিছু কাছের মানুষের সাথে শুধু কিছু বলা যায় মাত্র। 

২২ শে জুন মাকে নিয়ে একাই ভর্তি করে দিল সে আমাকে বি পি পোদ্দার হসপিটালের আইসোলেশন ওয়ার্ড এ । তখনো কোভিড হয়েছে বলে কেউ জানে না কিন্তু ফোন ছাড়া সরাসরি কেউ সামনে এলোও না। রাগ না, কোন দুঃখও না। এটাই ছিল স্বাভাবিক, এটাই হলো পরিস্থিতি। অন্যের হলে আমার আচরণ যে ভিন্নতর হতো তাও না। 

২২ শে জুন থেকে ২৬ শে জুন ছিল ভয়ঙ্করতম কালো দিন। ওই দিনগুলোতে বারবার বুঝলাম,  জীবন ও মৃত্যুর মাঝে আছে শুধু এক অতি অস্পষ্ট পেন্সিলের রেখা। ঠিকমতো যা বোঝাও যায় না কোন কোন সময়।  কিন্তু সেই দাগের দুপাশেই ঘটে চলেছে জীবন ও মৃত্যুর লাল ও নীল মেলা । 

পাশ থেকে, চোখের সামনে থেকে চলে যাচ্ছে আর থেমে যাচ্ছে জীবন। এই যিনি ছিলেন এই তিনি আর নেই। পাশের বেডটি শুধু আবার খালি হলো । বুঝতে পারছি সবকিছু। মাঝেমাঝে একটা হিম হিম ভাবনা মাথায় আসছে – ” আমার তবে কখন! “


দুটো হাত ছাড়া কিম্বা মুক্ত অবস্থায় থাকলেও যেখানে মানুষ কিছু লিখে উঠতে পারে না সেখানে আমার দুইহাতের উপরের পাতা এখন দারুণ করে সাজানো লাল নীল ও সাদা নানারকম ডাক্তারী চ্যানেলে। ওইগুলোই এখন নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে জীবনের প্রবাহের নানা দরকারি কথা আর তথ্য। ওখান দিয়েই ঢুকছে এখন  জীবন যুদ্ধের শক্তি আর রসদ । বুক, পিঠ আর পা সবকিছুকে ঘিরেছে আধুনিক চিকিৎসার অক্টোপাস। তাদের এক একটার চোষক বা বাহুর শক্তি মারাত্মক। একবার তা লাগালে আবার তাকে তোলা বেশ কঠিন। 

একটি মনিটর নানা শব্দে ও সংকেতে এবং রেখায় রেখায় প্রতি মুহূর্তে জানাচ্ছে জীবনের স্টেটাস। জানাচ্ছে – অবণী বাড়ি আছে না নেই। জানিয়েই যাচ্ছে, জানিয়েই যাচ্ছে তা।  

সেই শব্দ এতটাই তিতিবিরক্তিকর যে, নার্সদের বললাম,  ” এটা অসহ্য।  একে আর সহ্য করা যায় না।  “দুজনেই হাতজোড় করে বললেন,  ” এই শব্দটাই এখন আপনি স্যার। দয়া করে ওকে ভালোবাসুন আর সহ্য করুন। আমরা শুধু ওই শব্দটাই এখন  শুনতে চাই যে । আপনার খারাপ লাগলে তবু্ও “।  বুঝলাম কী তাঁদের অভিপ্রায় আর বক্তব্য। তাই অসহ্য শব্দটাকে আবার ভালোবাসতে শুরু করলাম । 

ওরা আমাকে আর কিছু খাওয়ায় না। কারণ সে চেষ্টা করেও লাভ হয় না। এমনকি ওষুধও না। শিরা ও ধমনীর চ্যানেলকাটা পথ দিয়ে সেসব মিশছে রক্তে ও দেহে । আমি এখন কিছু চ্যানেলের সমষ্টিমাত্র। 
*****
চার-পাঁচ দিনের লড়াইয়ে শ্বাসকষ্ট সংকটটা একটু স্থিতিশীল হলো আর সেদিন রিপোর্ট এলো আমি ” কোভিড পজিটিভ “।  সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে-জামাই, ছেলে এবং  ওদের পরামর্শদাতা শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল – আমাকে বেলেঘাটা আই ডি হসপিটালে নিয়ে আসার জন্য। ২৭শে জুন বেলেঘাটা আই ডি হসপিটালের সি সি ইউ তে চলে আসি । এখানকার চিকিৎসা পরিসেবা খুব ভালো। এখানকার সবাই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কতটা লড়াই করছেন তা বোঝা যায় চোখ দুটি খোলা থাকলে।

দুঃখের বিষয় হলো এখানে এই সি সি ইউ তে যাঁরা আছেন শারীরিক কারণে তাঁদের বেশিরভাগের চোখ বন্ধ আর নড়াচড়া নেই। সেই নিদারুণ শারীরিক অক্ষমতায় সে চোখ অনেকেরই হয়তো আর খোলা হবে না এ জীবনে। এতো কিছু যে আয়োজন সবকিছুই হবে ব্যর্থ । 

অনেকে জিজ্ঞেস করেছে, ” কীভাবে বাধালেন ?  “প্রশ্নটা খুব বোকা বোকা। রাজ্য, দেশ ও পৃথিবীজুড়ে যেখন কোভিড বা করোনা ভাইরাস সেখানে সংক্রামিত হওয়া বা না হওয়ার ঘটনা কেবলমাত্র চান্স ফ্যাক্টর ও ইমিউনিটি নির্ভর। কীভাবে হলো এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেওয়া সত্যি কারো পক্ষে সম্ভবই না।

যিনি ভালো আছেন তিনি ভালো আছেন হয়তো সেই চান্স ফ্যাক্টর ও ইমিউনিটি ফ্যাক্টরের কারণেই। এটা কি আমরা জানি যে, করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েও শুধুমাত্র ব্যক্তিগত শক্তিশালী স্বাস্থ্য ও ইমিউনিটির কারণে করোনার কোন প্রভাবই পড়েনি এমন বহু  মানুষ আছেন।  মনে রাখতে হবে তা যদি না হতো তাহলে এতদিনে গোটা দেশটাই  হাসপাতাল হয়ে যেত। 

কোভিড পজিটিভ হলে একটা মানুষের কী কী যে বদল হয়ে যায় তা আমি জানি না। অন্তত নিজের এই চরমদিনেও তা বুঝি নি। আমার শুধু মনে হলো অতীতের তুলনায় এবারের শ্বাসকষ্ট অনেক বেশি যা শ্বাসরোধও করতে পারে। এও বুঝলাম যে, আমার আসল শত্রুগুলো তো আমার মধ্যেই ছিল। তারাই কোভিডকে আশ্রয় বা প্রশ্রয় দিয়েছে কিম্বা ডেকে নিয়েছে। এবং এ ব্যাপার আমার কোন সন্দেহও নেই । 

আমার শারীরিক মানসিক অবস্থা এবং অসুস্থতার দিন তারিখের হিসাব করে ১ লা জুলাই বেলেঘাটা আই ডি হসপিটাল আমার ছুটি ঘোষণা করে এবং আমাকে বাড়িতে পৌঁছেও দেয়। 

এখন মানুষের কাছে আমার বলার শুধু একটিমাত্র কথা –  কষ্ট হলে বা আক্রান্ত হলেও আতঙ্কিত হবেন না। সঙ্গে সঙ্গে সঠিক স্থানেই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সাহায্য নিন এবং তার উপর আস্থা রাখুন। কোভিড বা করোনার সাথে লড়াই করার মানসিক প্রস্তুতিটা  সব সময়ের জন্য খুব দরকার । নিজের মনে রাখুন অসীম সাহস। কোভিড মানে আর কিছু করার নেই এবং সবই শেষ হয়েগেছে , এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন।  জানুন রোগটির সম্পর্কে ভালোভাবে এবং বিশদেই ।
 
মনে করুন না,  মরলোকের এই পৃথিবীতে মৃত্যু তো অবধারিত হয়েই রইল। যা অবধারিতভাবে আছে, তা থাক। আজ না হলেও কাল কিম্বা অন্য কোন একদিন তার সাথে দেখা তো হবেই। কিন্তু পরিবার, সমাজ, দেশ এবং  মানুষের জন্য এখনো যদি আপনার করার কিছু থাকে তাহলে আপাতত মৃত্যুর কথা ভাববেন না। ভাবুন শুধু বাঁচার জন্য।  

আমার সামনে থেকে কোভিড যে যে ক্ষেত্রে জীবন নিয়েছে তা দেখে আমার মনে হয়েছে তাঁদের বয়স, দীর্ঘদিনের শারীরিক নানা দুরারোগ্য  সমস্যা, অক্ষমতা এবং মানসিকভাবে লড়াই করার অসমর্থতা তাদেরকে সেইদিকেই ঠেলে দিয়েছে এবং ক্ষতিগুলো হয়েছে সেকারণেই ।  দুটি চিকিৎসা ক্ষেত্রেই  দেখেছি বয়স্ক এবং অপেক্ষাকৃত শারীরিক জটিল সমস্যায় জর্জরিত মানুষেরা শিকার হয়েছেন কোভিড এর । কোন ব্যবস্থাই শেষ পর্যন্ত আর কাজে আসেনি তাঁদের জন্য। তাঁদের ব্যক্তিগত সিস্টেম তা গ্রহণও করেনি বা করতে পারে নি। তাই বলছি – করোনা বা কোভিড নিয়ে  চিন্তা ও আতঙ্ক নয়, করোনা বা কোভিড সচেতনতাই হবে কোভিড প্রতিরোধের মূল হাতিয়ার। 

আমাদের দেশে এবং বর্তমান পৃথিবীতে কোভিডকে সাথে নিয়েই মানুষকে এগোতে হবে এটাই হলো এখন সারের সার ও খাঁটি কথা। তাই ভয় না, ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সাবধানতা দিয়েই জয় করতে হবে ‘কোভিড’কে । 

আমি গভীরভাবে এই প্রত্যয় রাখি, এরপর একদিন কোননা কোন বিজ্ঞান সাধক বলবেন, ” করোনার ভ্যাক্সিন বা করোনার টিকা এসে গিয়েছে মানবজাতির কাছে ” ।  তখন করোনা মেঘমুক্ত হবে মানুষ ও তার সভ্যতা । 

ততদিন, ঠিক ততদিন চলুক এই  অভূতপূর্ব বিপদের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত ও রাষ্ট্রীয় লড়াই।  

——————-+++++——————— 
বিঃদ্রঃ – অনবধানতায় যদি কোন গ্রন্থনপ্রমাদ বা অন্যরকম প্রমাদ কিছু ঘটে থাকে দয়াকরে তা ইনবক্সে জানিয়ে দেবেন।  

———————————————-★ Copyright :  Motiyur Rahaman /  মতিয়ূর রহমান । —–