পনেরোই আগস্ট।
১৯৪৭ সালে এই দিন ভারত স্বাধীন হয়েছিল, এবং আমাদের দেশকে ব্রিটিশরা তিন টুকরো করে দিয়ে, সব সম্পদ লুটে নিয়ে অবশেষে ফিরে গিয়েছিলো। অর্থনৈতিকভাবে এবং সামাজিকভাবে একটা অতি ধনী ভূখণ্ড ও তার মানুষকে দুশো বছরের মধ্যে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে, হিংসা ও ঘৃণার বীজ বুনে দিয়ে, এবং ফিউডাল ও রক্ষণশীল জাতের একটা শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে চলে গিয়েছিলো তারা। রক্তাক্ত হয়েছিল বিশেষ করে বাঙালি ও পাঞ্জাবি এই দুই জাতি।
এসব কথা কিছু কিছু অনেকে জানে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে যেটা জানেনা, বা তাদের জানানো হয়নি, তা হলো মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে আসার প্রায় একশো বছর আগে থেকেই ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানরা একসাথে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে, সর্বত্যাগ করেছে। জেলে অত্যাচারিত হয়েছে। ফাঁসি গেছে। শহীদ ভগৎ সিং, শুকদেব, রাজগুরু, ক্ষুদিরাম, চন্দ্রশেখর আজাদ, প্রফুল্ল চাকী, সূর্য সেন, প্রীতিলতা, বাঘা যতীন, বারীণ ঘোষ, বিনয়-বাদল-দীনেশ, কানাই-সত্যেন, উল্লাসকর, কল্পনা দত্ত। অসংখ্য নাম। বিবেকানন্দের ভাই বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বই “ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম” পড়ুন। কলকাতা ও ঢাকায় পাওয়া যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভগিনী নিবেদিতার সক্রিয় ভূমিকা। আবার পূর্ববঙ্গে বহু মুসলমান যুবক স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ হয়েছেন। আমরা তাঁদের মনে রাখিনি।
তারপর কংগ্রেস, নেতাজি সুভাষ বসু, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেহেরু, প্যাটেল, তিলক, সুরেন ব্যানার্জি, লাজপত রায়, বিপিন পাল, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। অসংখ্য নাম, বিশাল ইতিহাস।
রক্ত যারা দেয়নি, একফোঁটা রক্ত যারা দেয়নি ,স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেনি, লুকিয়ে ছিল, তারা আজ ভারতের শাসনক্ষমতায়। ও হ্যাঁ, ১৯৪৭’এর ১৫ই আগস্ট আর ১৯৪৮’এর ৩০শে জানুয়ারি — এই সামান্য সময়ের মধ্যেই তাদের কাজ ছিল গান্ধীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা। নাথুরাম গডসে, সাভারকার, গোপাল গডসে, আপ্টে, কারকার, পারচুরে, আরো কয়েকজন হিন্দুত্ববাদী হিংস্র লোক। প্রত্যেকেই আর এস এস, হিন্দু মহাসভা — এই সব চরমপন্থী, সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে যুক্ত সক্রিয় কর্মী।
আর এস এস কখনো গান্ধীহত্যার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। নাথুরাম গডসে ফাঁসির দড়িতে ঝোলবার আগে আর এস এসের প্রার্থনা “নমস্তে সদা বৎসলে মাতৃভূমে” আবৃত্তি করেছিল — এরকমই ইতিহাস পড়েছি আমি। আর এস এস নয়? (আমি আর এস এসে থাকার সময়ে এসব কথা কখনো শুনিনি। কেউ বলেনি।)
__________________________
ফাস্ট ফরওয়ার্ড। আমরা তখন কলেজে পড়ি। ১৯৭৫ — জরুরি অবস্থা ভারতে সবে জারি হয়েছে। এই সময়ে এক সন্ধ্যেবেলা পানের দোকানের ট্রানজিস্টর রেডিওতে খবর শুনলাম। ঢাকায় একদল হিংস্র আততায়ী শেখ মুজিবের বাড়িতে ঢুকে বাড়ির সবাইকে গুলি করে শেষ করে দিয়ে গেছে। শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। অনেক পরে ধানমণ্ডির সেই বাড়িতে গিয়ে দেখে এসেছিলাম। দেওয়ালে এখনো বুলেটের আর রক্তের দাগ।
কারা মেরেছিলো মুজিবকে? এখন আমরা সবাই জানি। ইসলামী চরমপন্থী, সন্ত্রাসী দলগুলোর লোকজন, আর তাদের সঙ্গী মিলিটারির কিছু সৈন্য ও জেনারেল। শেখ হাসিনা এবং বোন রেহানা সেই ভয়াবহ গণহত্যা থেকে রেহাই পেয়েছিলেন ভাগ্যক্রমে। তাঁরা তখন ব্রিটেনে ছিলেন। আজ শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শহীদের মেয়ে শহীদের রক্তের দাম বোঝেন।
হ্যাঁ, কংগ্রেস প্রচন্ড দুর্নীতি করেছে ভারতে। হ্যাঁ, মুজিবুর রহমান অনেক জনবিরোধী কাজ করেছেন ১৯৭১’এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫’এর আগস্ট পর্যন্ত। সমাজবাদী দলগুলোকে, শ্রমিক দলগুলোকে শেষ করে দিয়েছেন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক, পরিবারতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছেন। ঠিক ইন্দিরা গান্ধীর মতোই।
ঠিক যেমন মহাত্মা গান্ধী জমিদার, জোতদার, সামন্ততান্ত্রিক, রক্ষণশীল, এবং পুঁজিপতি শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষা করেছেন। বিপ্লবী ও বামপন্থীদের পাৰ্জ (purge) করেছেন কংগ্রেস থেকে। সমাজবাদী মনোভাবের, সৎ ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে ক্ষমতাহীন করেছেন।
______________________
কিন্তু তাও মহাত্মা গান্ধী শহীদ। শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ। ইন্দিরা গান্ধী শহীদ। রাজীব গান্ধীও শহীদ। ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়েছিল। ভগৎ সিং, শুকদেব, রাজগুরুর। দীনেশ গুপ্তর। প্রফুল্ল চাকীর মাথা কেটে ট্রেনে কলকাতায় পাঠিয়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ সনাক্ত করার জন্যে। সূর্য সেনকে জেলে অত্যাচার করে মেরে ফেলেছিলো ওরা। সন্ধ্যা, কল্পনাকে যৌন অত্যাচার করেছিল।
আর এস এস তখন নাগপুরে, বেনারসে রাস্তায় রুট মার্চ করছে।
__________________________
শেখ মুজিবকে মেরেছিলো কিসিঞ্জার ও সি আই এ (অর্থাৎ মার্কিন শাসকশ্রেণী)’র মদতপুষ্ট জঙ্গী ইসলামী শক্তি ও তাদের সমর্থক মিলিটারি। পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দিয়েছিলো মিলিটারি শাসকরা। তাদেরও পিছনে ছিল সিআই এ (অর্থাৎ মার্কিন শাসকশ্রেণী)।
আজ ভারতের স্বাধীনতা দিবস। একটু ইতিহাস পড়া, ইতিহাসের গল্প জানা — বোধহয় ভালো।
দেশপ্রেম হলো শিক্ষার, চেতনার আলোতে, ইতিহাসের আলোতে জীবন কাটানো।
অন্য সব দেশভক্তি — ওই নাথুরাম গডসে, সাভারকারের দেশপ্রেমের মতো।
____________________________________
কাল রেকর্ড করা আমার ভিডিও আলোচনা এখানে দেখুন প্রশ্ন করুন। চ্যালেঞ্জ করুন। শেয়ার করুন। Link at https://www.youtube.com/watch?v=uS8x2Il-o2U