তিরিশ বছর আগে যখন বিদেশী ছাত্র হয়ে আমেরিকায় এসেছিলাম, তখন এদেশটা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমাদের আগে আমাদের ফ্যামিলির কেউ কখনো এখানে এসে দীর্ঘকাল থাকেনি। কয়েকজন বন্ধুর পরামর্শে দেশের কলেজে পড়ানোর স্থায়ী চাকরি ছেড়ে দিয়ে এদেশে চলে এসেছিলাম অনেক ঝুঁকি নিয়ে। আজ তিন দশক পরে একবার ঘুরে দেখছি জীবনের দাঁড়িপাল্লায় কোনদিকটা ভারী হলো। দেশে থাকলে ভালো হত, না এখানে এসে বেশি ভালো হয়েছে। 

আসলে অনেক বড় বড় কথা, ভারী ভারী কথা লেখা যায়। বিদগ্ধ, পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা, বিতর্ক করা যায়। অনেক বড় বড় পন্ডিত করেওছেন। আমি পন্ডিত নই, তাই পন্ডিতের আলোচনা আমার শোভা পায়না। আমি আমার জীবন দিয়ে যা যা অনুভব করেছি, তার কিছু কিছু আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। 

আমার সদ্য-সমাপ্ত স্মৃতিকথা “ঘটিকাহিনি” কলকাতার রাবণ প্রকাশনা প্রকাশিত করেছেন। সে বইয়ের নাম দেওয়া যেতে পারতো “প্রথম জন্ম।”  এই খন্ডে আমি দেশের কথা লিখেছি। আমার কলকাতায় জন্ম, শৈশব,বাল্য, যৌবন এবং প্রথম চাকরির কথা। যে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমেরিকায় চলে এসেছিলাম। 

দ্বিতীয় খন্ড শুরু করব শীঘ্রই। ভেবেছি সে খন্ডের নাম দেব “পুনর্জন্ম।” জন্মসুত্রে আমি হিন্দু। ফলে, প্রথম জন্ম, পুনর্জন্ম এসব নাম দেওয়া আমার জন্যে একেবারেই সঠিক। 

আমেরিকায় আসাটা, এবং এখানে এতকাল থেকে যাওয়াটা, আমার কাছে একটা পুনর্জন্মই বটে। তবে, পুনর্জন্ম হলেই সে জীবন-যে সোনায় মোড়া হবে, এমন কোনো কথা নেই। জীবনের সংগ্রাম দেশে গরিব ঘরে জন্মানোর জন্যে যেমন তীব্রভাবে অনুভব করেছি, রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়েছি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতে, তেমনি আমেরিকাতেও বহু সংগ্রাম ও প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। 

মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, এ যেন আমার একটাই জীবন নয়। যেন, দুটো আলাদা অস্তিত্ব। যেন দুটো আলাদা জীবন। নইলে, এক জীবনে এতকিছু করা যায় কীভাবে?

আমেরিকায় যারা আসেনি, বা বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন থাকেনি, তাঁরা দেশে বসে বুঝতে পারেন না এদেশের আসল জীবনটা ঠিক কেমন। তাঁদের কাছে আমেরিকা এখনো সোনার দেশ। চারদিকে সোনা ছড়ানো আছে। যাকে এদেশের ভাষায় বলে, “দা স্ট্রিটস আর পেভ্ড ইন গোল্ড।” বহুকাল আগে থেকে চলে আসা কতগুলো শব্দ, কতগুলো বর্ণনা — যেসব কথাশুনে আমরা দেশে বড় হয়েছি, যা আমাদের কাছে স্বপ্নের মত ছিল, তা এখন ঠিক কেমন, সেটা এখানে এখনকার দিনে না এলে, বা এখানে জীবন না কাটালে ঠিক বোঝানো যায়না।
বিশেষ করে মার্কিন মুভি, মিডিয়া এবং তাদের দোসর আমাদের দেশের মিডিয়া, টিভি ও কাগজপত্রের কল্যাণে এদেশ সম্পর্কে এমন একটা মায়াজাল সৃষ্টি করা হয়েছে, যার অন্য দিকটা সম্পর্কে কেউ জানেনা। 

আমরা যারা এদেশে মানবাধিকার আন্দোলনে কাজ করি, শ্রমিক ইউনিয়নে হাজার হাজার সাধারণ লেবারদের সঙ্গে মিশি, পড়াই, এবং রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলি, তাঁদের বাড়ি যাই, তাঁদের অবস্থা দেখি, আমাদের অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্যরকম। সেই হলিউড আর মিডিয়ার মায়াজালের সঙ্গে একেবারেই মেলেনা। 

আবার দেশে যখন যাই, তখন অন্যরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। দেশের লোকেরা, বন্ধুরা, আত্মীয়রা, প্রতিবেশীরা, শুভানুধ্যায়ীরা আমার লেখালেখি ইত্যাদি পড়ে নানা প্রশ্ন তোলেন। তাঁরা আমাদের মতো লোকেদের, যারা এদেশে শুধু ডলার আর বিলাসিতার জন্যে পড়ে নেই, তাদের বিশ্বাস করতে চাননা। তাঁরা বলেন, “তোমরা ওদেশে এতদিন থেকে এত টাকা উপার্জন করেছ, ধনী হয়েছ, আর এখন আমাদের বলছ অন্য রকম কথা?”


এঁদের বোঝানো খুব মুশকিল পরিস্থিতিটা আসলে ঠিক কেমন। একটা লেখা লিখে, বা একটা আলোচনায় অংশগ্রহণ করে সব কথা বোঝানো সম্ভব নয়। বিশেষত, আমাদের মত লোকের কথা যখন সি এন এন, বা ফক্স বা নিউ ইয়র্ক টাইমসের মত দৈত্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তাদের বহুকাল ধরে সযত্নে তৈরী করা মিথ বা মায়াজাল কাটিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। এই দৈত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা কি সহজ কথা?

আবার এক ধরণের বাঙালি আছেন — দেশে ও আমেরিকায় — তাঁদের কাছে আমেরিকার সব কিছুই মন্দ। তাঁদের অনেকে এখানেই থাকেন, এখানেই অর্থ উপার্জন করেন, এখানেই তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে, মানুষ হচ্ছে, কিন্তু তাঁরা পাঁচ, দশ কি বিশ বছর আমেরিকায় থাকার পরেও এদেশ সম্পর্কে কোনো কিছুই জানবার, শেখবার চেষ্টা করেন নি। বলা যেতে পারে, তাঁদের শরীরটা শুধু এদেশে আছে, কিন্তু মনটা রেখে এসেছেন দেশে। তাঁরা দিনের মধ্যে পাঁচবার দেশে ফোন করেন, বা ক্যামেরায় কথা বলেন। এমনি করে থাকতে থাকতে তাঁরা এদেশের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র তৈরী করতে পারেন নি। তাঁদের ছেলেমেয়েরা যারা এদেশে বড় হচ্ছে, তাদের সঙ্গে তাদের বাবা মায়েদের মানসিক ব্যবধান ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। তাদের জীবনদর্শন আর তাদের বাবা মায়ের জীবনদর্শন দুই বিপরীত মেরুর। তারা পছন্দ করেনা তাদের বাবা মা সবসময়ে আমেরিকা সম্পর্কে নেতিবাচক বা নেগেটিভ কথাবার্তা বলেন। 

আমি শুনেছি, ইংল্যান্ডে, ক্যানাডায় বা অস্ট্রেলিয়ায় যেসব বাঙালি থাকেন, তাঁদের অবস্থাও এখানকার মতই। হয়ত কিছু এদিক ওদিক হতে পারে। কিন্তু, মূলত একই প্রকার। এমনভাবে জীবন কাটানো যায়না। আজকে ইমিগ্র্যান্টদের বিরুদ্ধে এক শ্রেণীর অতি-রক্ষণশীল মার্কিনিদের যে বিদ্বেষ, ট্রাম্প জাতীয় রেসিস্ট ও ফ্যাসিস্টদের যে ঘৃণা ও হিংসা — তার পিছনে যদিও দুশো বছরের বদ্ধমূল জাতিবৈষম্য ও ঘৃণা কাজ করছে, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে এক শ্রেণীর নেতিবাচক মনোভাবও দায়ী। আমি নিজে দেখেছি, অনেক বাঙালি বা ভারতীয় — ওদেশে ও এদেশে — আমেরিকা সম্পর্কে এবং এখানকার জীবনযাত্রা সম্পর্কে কী নেগেটিভ ধারণা পোষণ করেন। তাঁদের কাছে এদেশের সব কিছুই খারাপ। যাকে ইংরিজিতে বলে “ইভিল।” আর যাঁরা ধর্মান্ধ বা অতি গোঁড়া প্রজাতির, তাঁদের কথা ছেড়েই দিলাম। আরএসএস, বিজেপি বা জামাত ইসলামী বা ঐসব ফ্যানাটিক গোষ্ঠী। কোনো ধর্মেরই অতি-রক্ষণশীল লোকেদের প্রতি আমার কোনকালেই শ্রদ্ধা ছিলনা। 

আজকে চার্লসটন গির্জায় যে নারকীয় বন্দুকবাজি ও হত্যালীলা ঘটে, ফ্লোরিডা বা কানেক্টিকাটের স্কুলে, বা লাস ভেগাসের মেশিন গান গণহত্যা — তা এদেশের ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতা ও জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ যেমন প্রকট করে দেয়, তেমনই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের দেশে — বাংলাদেশে ও ভারতেও — আমরা কি এখন এই প্রজাতির ধর্মান্ধতা ও সার্বিক হিংসার উত্থান দেখছি না? এদেশে বন্দুকের অবাধ উপস্থিতি ও ন্যাশনাল রাইফেলস এসোসিয়েশন জাতীয় প্রাচীনপন্থী গ্রুপ ও তাদের অর্থবল ও রাজনৈতিক শক্তি যদি আমাদের দেশে থাকত, তাহলে সেখানেও আমরা এই একই ধরণের গণহত্যা প্রতিনিয়ত দেখতাম, এ বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। আমার কাছে খবর আসে, ভারতে কীভাবে বন্দুক ও অন্য নানারকম আগ্নেয়াস্ত্রের বিপুল সমাবেশ ঘটেছে, আর গান (বন্দুক) ক্লাব তৈরী হচ্ছে সর্বত্র। 

বাঙালি এক প্রগতিশীল, সহিষ্ণু, উদারমনা জাতি ছিল। আজ আর নেই। যাই হোক, এ রচনার বিষয়বস্তু তা নয়।

“ল্যান্ড অফ ফ্রীডম” যা আমেরিকার মিডিয়া সারা পৃথিবীতে প্রচার করেছে, আজ তা কতদূর সত্য? ঊনিশশো চল্লিশ থেকে আশি — এই চার দশককে আমেরিকার “গোল্ডেন এজ অফ ফ্রীডম” বলা হয়ে থাকে। এই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাঠামোতেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী, শ্রমজীবি শ্রেণী প্রভূত উন্নতি করেছিল, এবং ধন উপার্জন করেছিল। এবং তা সম্ভব হয়েছিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের “নিউ ডিল” বা নয়া চুক্তি আর্থ-সামাজিক নীতিমালার রূপায়ণের ফলে। এই চল্লিশ বছরে মার্কিনিরা পৃথিবীতে এক সুপারপাওয়ার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। অন্যদিকে ছিল রাশিয়া বা সোভিয়েট ইউনিয়ন। সেখানকার আর্থ-সমাজব্যবস্থা ছিল সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট। এখানে ছিল ক্যাপিটালিস্ট। কিন্তু এই ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমেও ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য কমে এসে ন্যুনতম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শ্রমিক ইউনিয়নগুলি শক্তিশালী ছিল, গরিব ও বঞ্চিত মানুষদের জন্যে রাষ্ট্রের নানা রকম সেবামূলক প্রোগ্রাম ছিল। এবং, সর্বোপরি, ধনীদের জন্যে ও তাদের কোটিপতি ব্যবসায়ীদের জন্যে ট্যাক্সের হার খুব বেশি ছিল। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের সময়েতেও আমেরিকায় সর্বোচ্চ ধনীরা ৯১ শতাংশ ইনকাম ট্যাক্স দিতো। কেনেডি বা কার্টারের মতো ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্টের সময়ে ৭০-৭৫ পার্সেন্ট। রেগানের সময় থেকে তা অবিশ্বাস্যভাবে কমে গিয়ে এখন এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৮ পার্সেন্ট। ফলে, রাষ্ট্রের উপার্জন অভাবনীয় রকম কমে গেছে। অনেক বিশালতম কর্পোরেশন নানা কায়দায় একেবারেই ট্যাক্স দেয়না। আমেরিকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ, লাইব্রেরি, পার্ক,যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা এই সবই সে সময়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল।  সাধারণ মানুষ এখনকার মত ঋণে ডুবে যায়নি। কলেজ শিক্ষা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁওয়ার বাইরে চলে যায়নি। মানুষ বাড়ি কিনে কয়েক বছরের মধ্যেই মর্টগেজ শোধ করে দিতে পারত। অর্থনৈতিক দিক থেকে মানুষ ছিল ফ্রী। স্বাধীন। এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার মেরুদন্ড, একথা কে না জানে?

এখন আমেরিকার অর্থনীতি ধনীদের অবিশ্বাস্য ধনী করেছে, আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী দরিদ্র শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। আমেরিকার সমগ্র সম্পদের ৯০ শতাংশ এখন শূণ্য দশমিক এক শতাংশ লোকের হাতে। যা বললে কেউ বিশ্বাস করবেনা। 

আশির দশকে আমেরিকায় রোনাল্ড রেগান এবং ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার এই দুজনে মিলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভোল পাল্টে দিয়ে গেছেন। এই সময়ে থেকে আমেরিকায় ও তার সৌজন্যে সারা পৃথিবীতে এক চূঁইয়ে পড়া অর্থনীতি চালু হয়েছে, ইংরিজিতে যাকে বলে “ট্রিকল ডাউন সিস্টেম।” এই নয়া ব্যবস্থায় ধনীরা প্রবল ক্ষমতাশালী হয়েছেন, এবং গরিবরা আরো গরিব হয়েছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছেন। আজ, এই ২০১৫ সালে, আমেরিকার উচ্চবিত্তদের মধ্যে যাদের আমরা ওয়ান পার্সেন্ট বলে থাকি, সেই ওয়ান পার্সেন্টেরও দশ ভাগের এক ভাগ মানুষ, অর্থাৎ আমেরিকার তিনশ তিরিশ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র তিন কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষের কাছে যে ধন সম্পদ আছে, তার বাকি ৯৯.৯ শতাংশ মানুষের সমান। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ভয়ংকর সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্য আগে কখনো দেখা যায়নি।

এছাড়া, আমেরিকায় বিশেষ করে এগারোই সেপ্টেম্বরের মর্মান্তিক, সন্ত্রাসী ঘটনার পর সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতন অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কালো মানুষদের ওপর ও নতুন ইমিগ্র্যান্টদের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন নেমে এসেছে ভীষণভাবে। এর ওপর আছে গুপ্তচরবৃত্তি ও নজরদারি। উইকিলিক্স কোম্পানির জুলিয়ান আসাঙ্গে ও এডওয়ার্ড স্নোডেন ফাঁস করে দিয়েছেন, আমেরিকার শক্তিশালী কর্পোরেশনগুলো গভর্নমেন্ট-এর নির্দেশে সাধারণ মানুষের ওপর কী ভয়ানক গুপ্তচরবৃত্তি করে চলেছে।

এই-কি “ল্যান্ড অফ ফ্রীডম”? এই যদি ফ্রীডম হয়, তাহলে তার সংজ্ঞা কী? 

অন্যদিকে, ব্রিটিশ সমাজতাত্ত্বিক উইলকিনসন ও পিকেট তাঁদের বিখ্যাত গ্রন্থ “দা স্পিরিট লেভেল”-এ গবেষণা করে দেখিয়েছেন-যে তথাকথিত “আমেরিকান ড্রিম” আজ শুধু এক মায়াজাল ছাড়া কিছুই নয়। তাঁরা দেখিয়েছেন-যে ধনতান্ত্রিক ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার অবস্থা সব চাইতে খারাপ। রুজির চরম বৈষম্য একদিকে আমেরিকায় সামাজিক ও স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যাকে অতি জটিল এক চেহারা দিয়েছে। ড্রাগ ব্যবহার, বন্দুকবাজি, হত্যা, স্কুল ছেড়ে দেওয়া, ওবেসিটি বা অতি-স্থূলতা, টিনএজ বয়েসে গর্ভধারণ ইত্যাদি সমস্যা আমেরিকায় ধনী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক। অন্যদিকে, সেই একই অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে গরিব অবস্থা থেকে ধনী হওয়া আমেরিকার মানুষদের পক্ষে সব চাইতে অসম্ভব। এ তুলনা কেবলমাত্র তাঁরা করেছেন ধনী ও পুঁজিবাদী দেশগুলোকে নিয়ে। সুইডেন, জাপান, জার্মানি, বেলজিয়াম এসব বিষয়ে আমেরিকার চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে।এমনকি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ক্যানাডার অবস্থাও আমেরিকার চেয়ে অনেক ভালো।

কিন্তু, আমেরিকার মূলস্রোত সংবাদ মাধ্যমে যেমন নিউ ইয়র্ক টাইমস, সি এন এন, ফক্স বা এন বি সি ও এ বি সি’তে আপনি এসব খবর পাবেন না। তারা এখনো প্রমাণ করতে ব্যস্ত আমেরিকাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ। আর দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল — রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা — সেই প্রোপাগান্ডাই চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রেষ্ঠ হলে কোনো আপত্তি ছিলনা। যে দেশে থাকি, সেদেশ শ্রেষ্ঠ হলে নিজেদের ভালই লাগত। সমস্যা হলো, শ্রেষ্ঠ আর নেই। ল্যান্ড অফ ফ্রীডমও মায়াজাল। আমেরিকান ড্রিম’ও মিথ্যা, অসার।

এই তীব্র বৈষম্যমূলক ও যুদ্ধবাদী ব্যবস্থার অবসান না হলে এই বিশ্বব্যাপী সংকট থেকে আমাদের মুক্তি নেই।

আশির দশকের মাঝামাঝি যখন এদেশে এসেছিলাম চাকরিবাকরি ছেড়ে দিয়ে, এবং পরিবার পরিজন সমাজ সংস্কৃতিকে পিছনে ফেলে, তখন এসব কথা জানতাম না। জানলে হয়ত আসতাম না। যাই হোক, সে কথা ভেবে এখন আর লাভ নেই। এখন এদেশে থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে মূলস্রোতে মিশে কিছু সংঘবদ্ধ কাজ করে যেতে পারি। কারণ, যে দেশে থাকি, সেদেশটাকেই নিজের মত করে বসবাস করা ভালো। এদেশে বসে থেকে, এদেশে উপার্জন করে, সুযোগ সুবিধে যা এখনো অবশিষ্ট আছে তা কাজে লাগিয়ে এদেশের নিন্দামন্দ করে বাঁচা কোনো কাজের কথা নয়। 

নিন্দা যা করব, সেই প্রবল ক্ষমতাধর উচ্চশ্রেণীর এক শতাংশদের বিরুদ্ধে করব। সাধারণ মার্কিনিদের বিরুদ্ধে নয়। কারণ, তাঁরা আর আমরা আলাদা নই। আমাদের সকলেরই জীবনসংগ্রাম ও স্বপ্ন একই। 

______________________________________________________________________________
[ছবি পরিচিতি — উইলকিনসন ও পিকেট তাঁদের “দ্য স্পিরিট লেভেল” (২০১০) বইতে দেখিয়েছেন, অশ্রুতপূর্ব অর্থনৈতিক বৈষম্য ও তার ফলে সামাজিক ও স্বাস্থ্য সমস্যা ধনী দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকাকে সবচেয়ে পিছনে ফেলে দিয়েছে।]