সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ এখন হলো, মানুষকে কীভাবে বোঝানো যাবে যে পড়াশোনা, চিন্তাভাবনা, বিশ্লেষণ করার, প্রশ্ন করার অসম্ভব বেশি দরকার হয়ে পড়েছে। এবং তার দুটো অংশ।

(১) কীভাবে সেই বোঝানোটা যাবে — কী ভাষায়, অর্থাৎ, কতটা সহজবোধ্য করে? এই কাজটা আমি বহুকাল ধরে একটু রপ্ত করেছি বাংলা আর ইংরিজি ভাষায়। অনেক রেসপন্স পেয়েছি, এবং পাচ্ছি।

আর 

(২) কোন কোন বিষয়ে কথা বললে মানুষ সাড়া দেবে, এবং কোন কোন বিষয়ে কথা বললে তারা আরো বেশি গুটিয়ে যাবে? অর্থাৎ, সোজাসুজি পলিটিক্সের কথা শুরু করলে বেশির ভাগ মানুষ বোধহয় আজকাল ভয় পেয়ে যাবে, বা চুপ করে যাবে। কিন্তু ক্রিকেট, পুজোর বাজার, বলিউড, বা এখন ধরুণ এই নিউ ইয়ার্স ডে পার্টি, ফান — এসব নিয়ে কথা বললে, ছবি পোস্ট করলে প্রচুর লাইক পাওয়া যাবে — সোশ্যাল মিডিয়াতে, এবং বাস্তব জীবনে।

আচ্ছা। গুড। এখন সেই লোকগুলোকে (লোক বলতে আমি পুরুষ ও মহিলা সবাইকেই বোঝাচ্ছি) যদি মাঝে মাঝে একটু রাজনীতি, অর্থনীতির কথা, পকেটের কথা, পলিউশন বা স্বাস্থ্য সংকটের কথা, বা ধরুণ ম্যাকডোনাল্ড, কোক, কে এফ সি জাতীয় বিষাক্ত খাবার ও পানীয়ের কথা, প্লাস্টিক ব্যবহারের কথা, বা ধরা যাক মেডিকেল, এডুকেশন, তেল বা গ্যাসের খরচ, গাড়িভাড়া, ট্রেনভাড়া, নানারকমের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ট্যাক্স — এসব নিয়ে একটু কথা বলা যায়? কতজন সাড়া দেবে, এবং কীভাবে দেবে?

শাসক শ্রেণী চায়, এসব বিষয় নিয়ে যেন বেশি কথাবার্তা লোকে না বলে, এবং সবাই যেন ওই পার্টি, ফান, বলিউড, ক্রিকেট, বা এখন হয়েছে পর্ণোগ্রাফি — এসব নিয়েই ডুবে থাকে।

এই হলো ইয়ং জেনারেশন এবং শহরের লোকেদের জন্যে দাওয়াই। দাওয়াই নয়, ড্রাগ। এল এস ডি, বা মেট জাতীয় ভয়ঙ্কর ড্রাগের থেকেও বেশি শক্তিশালী তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া, ঘুম পাড়িয়ে রাখার ক্ষমতা। ইল্যুশন, মায়া, মোহের মধ্যে জীবন কাটানোর স্বপ্ন। যে স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই।

আর গ্রামের লোকেদের জন্যে, বা ওল্ডার জেনারেশনের জন্যে অন্য ড্রাগ। ধর্মান্ধতা, নারীবিরোধিতা, মুসলমানবিরোধিতা (বা মুসলমানপ্রধান দেশে হিন্দু-বিরোধিতা), আমেরিকায় ও ভারতে ইমিগ্রেন্ট-বিরোধিতা, এইসব। নিম্নবর্ণের জাতি বা বর্ণ বিরোধিতা — ভারতে দলিত বা অচ্ছ্যুতদের ঘৃণা, এবং আমেরিকায় ব্ল্যাক ও নথিহীন গরিব ইমিগ্রেন্টদের ঘৃণা। একই ব্যাপার।

যেহেতু মূলস্রোত মিডিয়াতে মানুষ কোনো সঠিক উত্তর পায়না তাদের প্রশ্নের, ফলে বহুকাল ধরে কর্পোরেট মিডিয়ার দেওয়া বুলশিটেই সবাই সন্তুষ্ট থেকেছে। সম্পূর্ণ মগজধোলাই হয়ে গেছে ৯০ শতাংশ লোকের। আসলে কোনো গণতন্ত্র নেই, কোনো আসল বিতর্ক নেই, কিন্তু সবাই ভাবছে এটাই গণতন্ত্র, আর এটাই ফ্রি স্পিচ। বাক স্বাধীনতা।

নয়া ঔপনিবেশিক রাজনীতি, অর্থনীতি, আর সমাজনীতির একটা প্রধান অস্ত্রই হলো মানুষকে প্রশ্ন করা, চ্যালেঞ্জ করা, বিশ্লেষণ, বিতর্ক করা থেকে সরিয়ে রাখা। ফান, পার্টি ও বিলাসিতার মধ্যে ডুবিয়ে রাখা।

যারা প্রশ্ন করবে, চ্যালেঞ্জ করবে, শেখাবে অন্যভাবে ভাবতে, তাদের হয় সামাজিকভাবে ব্রাত্য করে রাখা হবে। কোনো গ্যাদারিং বা পার্টিতে তারা এক কোণে কিছুক্ষণ বসে থাকবে, তারপরে উঠে চলে যাবে। কেউ তাদের মিস করবেনা। আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাদের গৌরী লঙ্কেশ, বা অভিজিৎ রায় করে দেওয়া হবে।

এই হলো নিওলিবারাল অর্থনীতির বিশ্বায়িত রূপ। মার্কিন মডেল, বিশ্বব্যাংক মডেল, ওয়াল স্ট্রিট মডেল। যা এখন ভারত সবচেয়ে দ্রুত গ্রহণ করেছে। ভারত ও ভারতীয়রা সবসময়েই বেস্ট কপিক্যাট স্টুডেন্ট। চিরকাল। মৌলিক চিন্তার চেয়ে অনুকরণ-ভিত্তিক শিক্ষা আমরা পেয়েছি গত দুশো তিনশো বছর ধরে। সুতরাং, মার্কিনি মডেলের আর্থ-সমাজনীতি ভারতকে সবচেয়ে দ্রুত গ্রাস করেছে।

এই অবস্থার মধ্যে আমি আমার নতুন মিডিয়া তৈরী করছি নিজের সময় ও অর্থ ব্যয় করে। আমি জানি, প্রথমেই খুব বেশি সাড়া পাওয়া যাবেনা। অনেকে সন্দেহ করবে, অনেকে হয়তো ভয় পাবে। অনেকে ভাববে, আমার নিশ্চয়ই কোনো লুকোনো এজেন্ডা আছে। 

কিন্তু আমি এও জানি, এই কাজটা সবাই করতে পারেনা। অনেকেই অপেক্ষা করে আছে একটা সৎ, সক্ষম, এবং সুযোগ্য নেতৃত্বের। বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আমি মিডিয়া ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সেই অভাবটা পূর্ণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

কাজটা সহজ একেবারেই নয়। কিন্তু অসম্ভবও একেবারেই নয়। আমার একার পক্ষে এ কাজ সম্ভব হবেনা। আপনাদেরও যুক্ত হতে হবে।

আমার এই নতুন মিডিয়াকে আপনার নিজের মিডিয়া করে তুলুন। যোগ দিন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করুন। আমি কোনো কর্পোরেশন, রাজনৈতিক দল, বা অন্য কোনো গোপন স্বার্থ নিয়ে এই কাজ শুরু করছিনা। শুধুমাত্র একটা নতুন গণতান্ত্রিক এবং মুক্ত প্ল্যাটফর্ম সবার কাছে তুলে ধরছি। নতুনভাবে খবর ও তার বিশ্লেষণ করার চ্যালেঞ্জ সবার সামনে রাখছি। শুধু রাজনীতি নয়। সঙ্গীত, সাহিত্য, সিনেমা, বিজ্ঞান, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সমাজ — সবকিছু নিয়েই আলোচনা হবে এখানে। 

ইংরিজি নতুন বছর ২০১৯’এর শুভেচ্ছা ও প্রীতি আপনাদের জন্যে থাকলো। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলাম। 

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় (ব্যানার্জী)

উপরে আমার নামের লিংকে ক্লিক করলেই আমার উইকিপিডিয়া পেজ দেখতে পাবেন। 

ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক